
মৌখিক, নাসিক্য ও আনুনাসিক ধ্বনি
প্রশ্ন: মৌখিক, নাসিক্য ও আনুনাসিক ধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণসহ এদর ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
উত্তর: নিচে মৌখিক ,নাসিক্য ও আনুনাসিক ধ্বনির ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
মৌখিক: যে সকল ধ্বনি উচ্চারণের সময় নরম তালু উপরে উঠে নাসিকাগহ্বরের পিছনের অংশ স্পর্শের মাধ্যমে নাসিকাগহ্বর বন্ধ করে দেয় এবং বার্হিগামী বাতাস নাক দিয়ে না বেরিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় সে সকল ধ্বনিকে মৌখিক ধ্বনি বলে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৌখিক স্বরধ্বনি তথা অ, আ, ই. উ, এ, এ্যা, ও, এবং ন,ঙ,ম,ঞ,ণ ব্যতীত অন্য সব ব্যঞ্জন ধ্বনি গঠিত হয়। তাই আমরা বলতে পারি যে অ,আ,ই.উ.এ.এ্যা,ও এবং ন,ঙ,ঞ,ণ ব্যতীত অন্য সব ব্যঞ্জন ধ্বনি মৌখিক ধ্বনির অন্তর্গত।
নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি: বাংলা নাসিক্য ধ্বনি স্পৃষ্ট ধ্বনের ন্যায় বায়ুপথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ অবস্থায় গঠিত হয়। তবে স্পৃষ্ট ধ্বনির সঙ্গে নাসিক্য ধ্বনির পার্থক্য আছে। নাসিক্য ধ্বনি গঠনে বায়ুপথ রুদ্ধ হলেও পিছনের তালুর পথ খোলা থাকে। তবে বাতাস অবরুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও মুখ দিয়ে বের হতে না পেরে উচ্চারণের স্থানে জমা হয় না। বরং নাসিক্য গহ্বর দিয়ে বের হয়ে যায়। আর এই অবস্থায় যে ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তাই নাসিক্য ধ্বনি। বাংলায় তিনটি নাসিক্য ব্যঞ্জন ধ্বনি রয়েছে। যথা:
h n m
ঙ/ং ন ম
উল্লিখিত নাসিক্য ধ্বনিসমূহ গঠনের সময় মৌখিক অনুনাদের পার্থক্যের জন্য ভিন্নতর শ্রুতিগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। তাছাড়া বাক প্রত্যঙ্গেও বিভিন্ন প্রকার আলোড়ন দেখা যায়। /ম/,ধ্বনি উচ্চারণের সময় ঠোঁট দুটো বন্ধ থাকে। এ ধ্বনি উচ্চারণে জিভের অবস্থায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। /ন/, উচ্চারণের সময় মৌখিক অবরোধ লক্ষণীয় । এ ধ্বনি উচ্চারণে নরম তালুর নিচে নেমে আসে। /ঙ/, ধ্বনি উচ্চারণের সময়ও নরম তালু নিচে নেমে আসে।
ন : ‘ন’ এর উচ্চারণ স্থান , উপরের বড় দুই দাঁতের পিছনের মাড়ি যেখানে একটু উত্তল হয়ে উঠে, সেখানে। সেজন্য ‘ন’ কে দন্ত্য ‘ন’ বলা চলে না। বলা উচিত দন্তমূলীয় ন। ‘ন’ এর দন্ত্য উচ্চারণ কেবল ত-বর্গীয় বর্ণের পূর্বে পাওয়া যায়, অন্য কোথাও নয়। যেমন: ‘ছন্দ’ এখানে ‘ন’ দন্ত্য ধ্বনি। কিন্তু ‘পান’ এখানে ‘ন’ দন্তমুলীয়। আসলে ‘ন’-ই বাংলা দন্তমূলীয় নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি। দন্ত্য ‘ন’ তার সহধ্বনি।
দন্তমূলীয় নাসিক্য ‘ন’ এর দন্ত্য ‘ন’ ছাড়াও দুটি সদস্য আছে। একটি ঞ এবং অপরটি ণ। ঞ শব্দমধ্যবর্তী চ-বর্গীয় বর্ণের পূর্বে এবং ‘ণ’ ট বর্গীয় বর্ণের পূর্বে ব্যবহৃত হয়।
ম: বাংলায় দ্বিতীয় নাসিক্য ধ্বনি হলো ‘ম’। ‘ম’ ধ্বনিটি গঠন কালে দু’ঠোট পরস্পর মিলিত হতে না হতেই ঠোঁটের অমুক্ত অবস্থায় নিচের চোঁয়াল কিছুটা নেমে আসে। ফলে মুখের ভিতর গভীরতর গহ্বরের সৃষ্টি হয়। সাথে সাথে নাসা পথও সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এভাবে মুক্ত নাসা পথ দিয়ে ফুসফুস চালিত বাতাস বের হতে গিয়ে মুখের ভেতরে গভীর মনোহর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে ‘ম’ ধ্বনিটি। অন্যান্য নাসিক্য ধ্বনি মতো ‘ম’ প্রলম্বিত।
ঙ: নাসিক্য বঞ্জনের শেষ ধ্বনি ‘ঙ’। ‘ঙ’ ধ্বনিটি উচ্চারণ কালে জিভের পিছনের দিকে নরম তালুর পশ্চাৎ ভাগের সাথে উঠিয়ে ধরতে হয়, তখন নাসাপথ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থায় ফুসফুস চালিত বাতাস নাসাপথ দিয়ে বের হয়ে ‘ঙ’ ধ্বনির ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। ‘ঙ’ ধ্বনিটি শব্দের মধ্যে অথবা শেষে ব্যবহৃত হয়। যেমন: বাঙলা,রঙ।
আনুনাসিক স্বরধ্বনি: স্বরধ্বনি গঠনের সময় নরম তালুর অবস্থানের জন্যে স্বরধ্বনির প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার সময় নাক ও মুখ উভয় বাকপ্রত্যঙ্গের মধ্যদিয়ে বেরিয়ে গেলে স্বরধ্বনি মৌখিক স্বরধ্বনির পরিবর্তে আনুনাসিক স্বরধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়।
ফুসফুস থেকে বাতাস সাধারণত নাসা পথেই নির্গত হয়। স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় তালুর নরম অংশ উঁচু হওয়ার কারণে নাসা পথ মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখন ফুসফুস তাড়িত বাতাস শুধু মুখ দিয়ে নির্গত হয়। কিন্তু কোনো কোনো সময় তালুর নরম অংশ না নিচু না উচুঁ অবস্থানে থাকে। ঠিক এমনি সময় ফুসফুস তাড়িত বাতাস নাক ও মুখ উভয় পথ দিয়ে বের হয়। এই অবস্থায় যে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়- তাকেই আনুনাসিক বা সানুনাসিক স্বরধ্বনি বলে। বাংলায় সমস্ত মৌখিক স্বরধ্বনিই আনুনাসিক স্বরধ্বনি। কিন্তু কোন ব্যঞ্জনধ্বনিই এই পর্যায়ভুক্ত নয়।
বাংলায় আনুনাসিক স্বরধ্বনি মৌখিক স্বরধ্বনির সমান । অর্থাৎ এর সংখ্যা হলো সাত। এগুলো হলো: অঁ, আঁ, ইঁ, উঁ, এঁ, এ্যাঁ, ওঁ।
বাংলায় আনুনাসিক স্বরধ্বনিগুলো চিহ্নিত করা হয় চন্দ্র বিন্দুর (ঁ) সাহায্যে। যেমন:
অ>অঁ= বঁধু. আ>আঁ=ফাঁস
ই>ইঁ=ইঁদুর উ>উঁ=উঁচু
এ>এঁ=গেঁজেল এ্যা>এ্যাঁ=ছ্যাঁকা
ও>ওঁ=ওঁত
বাংলা রূপমূলে মৌখিক স্বরধ্বনি আনুনাসিক স্বরধ্বনিতে পরিণত হয়। যখন অন্য একটি নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যঞ্জনধ্বনির পরে বসে। উচ্চারণের সময় রূপমূলের মধ্যের নাসিক্যবঞ্জনধ্বনি লুপ্ত হয় এবং নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি অব্যবহিত পরের স্বরধ্বনি আনুনাসিক প্রাপ্ত হয়।এই প্রক্রিয়ার জন্য রূপমূলে আনুনাসিক স্বরধ্বনির পূর্বে বা পরে নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয় না। সাধু বাংলা থেকে চলিত বাংলায় পরিবর্তনের সময় রূপমূলে এ ধরণের পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন:
সাধু চলিত
চন্দ্র চাঁদ
অংশ আঁশ
পঙ্ক পাঁক
ড. এ. আই. এম. মুসা
সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর।
+88 01713 211 910