
রস কত প্রকার ও কী কী? উদাহরণসহ প্রত্যেক প্রকার রসের পরিচয়
প্রসঙ্গ : রস কত প্রকার ও কী কী? উদাহরণসহ প্রত্যেক প্রকার রসের পরিচয় দাও।
আলোচান : ভারতীয় আলঙ্কারিকদের মতে রস নয় প্রকার। এগুলো হলো নিম্নরূপ-
১। শৃঙ্গার বা আদি রস, ২। বীররস, ৩। রৌদ্ররস ৪। হাস্য রস, ৫। করুণ রস,
৬। ভয়ানক রস, ৭। ভীবৎস রস ৮। অদ্ভুত রস, ৯। শান্ত রস।
উল্লিখিত নয়টি রসের নয়টি স্থায়ী ভাব রয়েছে। এগুলো হলো-রতি, উৎসাহ ক্রোধ, হাস, শোক, ভয়, জুগুপ্সা, বিষ্ময় এবং শম। নিচের নয়টি রসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং উদারহণ দেয়া হলো-
১। শৃঙ্গার বা আদি রস: রতি স্থায়ী ভাব থেকে শৃঙ্গার রস বা আদি রসের উৎপত্তি। আলঙ্কারিকগণ শৃঙ্গার রসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন: সম্ভোব শৃঙ্গার এবং বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার। নায়ক নায়িকার মিলনকালীন রতিভাব থেকে সম্ভোগ শৃঙ্গার রসের উৎপত্তি এবং তাদের বিরহকালীন রতিভাব থেকে বিপ্রলব্ধ শৃঙ্গারের উৎপত্তি। নিচে শৃঙ্গার বা আদি রসেরে উদাহরণ দেওয়া হলো:
“নাহি জানি কখন কী ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণ করে কুলায় প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো। মুখখানি তার
নতবৃন্ত পুষ্পসম এ বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে। ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস।”
২। বীররস: উৎসাহ স্থায়ীভাব থেকে বীররসের উৎপত্তি। অলঙ্কার শাস্ত্র অনুসারে দয়া, ধর্ম. দান কিংবা মহত্ত্বর কোনো সংগ্রামের হেতু মানুষের চিত্তে যে উৎসাহ জন্মে, সে ভাব থেকেই বীররসের উদ্ভব। যেমন-
(ক) “সাবাসি দূত। তোর কথা শুনি,
কোন বীর –হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে
সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কালফণী
কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে
ধন্যলঙ্কার বীরপুত্রধারী।” (মেঘনাদ বধ ১ম সর্গ)
(খ) স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃঙখল আজি কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়।
৩। রৌদ্ররস : রৌদ্র রসের স্থায়ীভাব ক্রোধ। সাধারণত প্রতিপক্ষ শত্রু এর আলম্বন বিভাব হয়ে থাকে এবং তার চেষ্টাদি উদ্দীপন বলে কথিত হয়। অর্থাৎ জঘন্য অন্যায়কারীর প্রতি আমাদের হৃদয়ে যে স্বাভাবিক রোষানল প্রজ্বলিত হয়, তারই কাব্যরূপ রৌদ্ররস।
যেমন- ক) কি কহিলি বাসন্তি? পবর্বতগৃহ ছাড়ি
বাহিরায় যবে নদী সিন্দুর উদ্দেশ্যে,
কার হেন সাধ যে সে রোধে তার গতি?
দানব নন্দিনী অমি রক্ষ কুলবধু,
রাবণ শ্বশুর মম; মেঘনাদ স্বামী-
আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?
৪। হাস্যরস: এ রসের স্থায়ীভাব হাস। কৌতুকজনক কোন কাজ বা বাক্য হতে এ রসের উৎপত্তি। যেমন-
ক) ‘নিষ্মাইয়া দিব লঙ্কা যত গেছে পোড়া।
সুপর্ণখার নাক কান কিসে যাবে জোড়া
অক্ষয় কুমারেরে মেরেছে রামের চরে
তার স্ত্রী বিধবা হয়ে আছে তার ঘরে
সে তার দারুণ পণ এমন করে কে
কবে বলবি আমার বধুর স্বামী এনে দে।”
৫। করুণ রস: শোকস্থায়ী ভাব থেকে করুণ রসের উৎপত্তি। শোকের বিষয় এর আলম্বন বিভাব এবং এ বিষয় দর্শন, শ্রবণ কিংবা মননাদি এ রসের উদ্দীপন বিভাব। যেমন-
ওই দুর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
৬। ভয়ানক রস : ভয় হতে ভয়ানক রসে উৎপত্তি: বিভীষিকা এর আলম্বন বিভাব এবং ভয়জনিত চেষ্টাদি এর উদ্দীপনা বিভাব। যেমন-
কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বারতা?
মদকল করী যথা পশে নলবনে,
পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে
ধনুর্দ্ধুর। এখনও কাঁপে হিয়া মম
থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে।
৭। বীভৎস রস : কোন কুৎসিত বিষয়ের প্রতি জুগপ্সা বা Disgust বা ঘৃণার ভাব থেকে বীভৎস রসের জন্ম। উদারহণ-
সে রোগের পাশে
বিশাল উদর বসে উদরপরতা
অজীর্ণ ভোজন দ্রব্য উগরি দুর্মতি
পুনঃ পুনঃ দুই হস্তে তুলিয়া গিলিছে সুখাদ্য।
৮। অদ্ভুত রস : এ রসের স্থায়ী ভাব বিষ্ময়। আলঙ্কারিকদের ভাষার, অদৃষ্টর্পূব বা অশ্রুত পূর্ব কোন অদ্ভুত পদার্থ দর্শণে কিংবা শ্রবণে সহৃদয় পাঠক মাত্রের পুলকাদিজনক চিত্তবিস্তারকে বিষ্ময় বলা হয়। উদাহরণ-
সেই স্বপ্ন আজি
এসেছে কি পাণ্ডব জননী রূপে সাজি
সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্রে, ভাগীরথী তীরে।
৯। শান্তরস :- পরম শান্তি বা নির্বেদ ভাব হতে শান্তরসের উৎপত্তি। অর্থাৎ জাগতিক জীবনে প্রতিটি বস্তুর চরম নশ্বরতা প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির চিত্তে এক ধরণের বৈরাগ্যভাবের সৃষ্টি হয়। এই বৈরাগ্যভাবই যখন কাব্যে রূপলাভ করে তখন তাকে শান্ত রস বলা হয়।
যেমন- ক) কিন্তু চিরস্থায়ী কিছু নহে এ সংসারে
এক যায় আর আসে, জগতের রীতি
সাগরতঙ্গ যথা।
খ) আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি
আমার যতহ বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী।
ড.এ. আই. এম. মুসা
সহযোগী অধ্যাপক বাংলা
সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর।