
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে? বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উপযোগিতা
প্রশ্ন : রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে? বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উপযোগিতা যাচাই কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যায়নের উপযোগিতা আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কী? বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের উপযোগিতা আলোচনা কর।
উত্তরঃ ‘রাষ্ট্র’ হচ্ছে সমাজের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা সমাজভূক্ত মানুষের সমগ্র জীবন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সংগঠনের মধ্যেই আমরা বসবাস করি, লালিত-পালিত হই এবং মৃতুবরণ করি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল যথার্থ বলেছেন, “মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব, যে সমাজে বাস করে না সে হয় পশু না হয় দেবতা।”
Political Science এই ইংরেজি শব্দের বাংলা সমার্থক শব্দ হলো ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’। Political Science বা Politics শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Polis থেকে যার অর্থ city state বা নগররাষ্ট্র। সুতরাং নগররাষ্ট্র যাবতীয় সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তাকেই বলে অভিহিত করা হয়।
আধুনিককালে রাষ্ট্র বলতে আর গ্রিসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রকে বুঝায় না। আধুনিক রাষ্ট্র বিশাল, বিস্তৃত ও জনবহুল। এরূপ রাষ্ট্র আকৃতি ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই গ্রিক নগররাষ্ট্র থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। সুতরাং আধুনিক অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে রাষ্ট্র বিষয়ক এমন একটি বিষয়কে বুঝায় যা মানুষের আচার- আচরণ ও কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে।
তাই আমরা বলতে পারি মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল বিষয়, প্রতিষ্ঠান ও কার্যাবলি নিয়ে যে শাস্ত্র বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে, তাকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে।
১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রদত্ত সংজ্ঞা : বিভিন্ন লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো।
পল জানেট (Paul janet) এর মতে, “ রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা যা রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকারের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করে।” (Political science is that part of social science which deals the foundations of the state and principles of the government.)
জর্জ ক্যাটলিন ( George Catlin) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজে মানুষের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ব্যাখ্যা দান করে এবং সমাজে মানুষের বিভিন্নমুখী বিশদ বিবরণ দান করে।” (Political secience deals with political activities of men is society and their defferent social roles.)
অধ্যাপক লাস্কি (Laski) এর মতে, “সংগঠিত রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনাই হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান।”( Political science concerns itself wth the life of men in relation to organized state.)
উইলোবি (Willoughby) এর মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো সেই বিজ্ঞান যার লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক সত্যগুলো নিরূপণ করা এবং তাদের মধ্যকার যুক্তিগত ও কার্যকারণগত সম্পর্ক অনুযায়ী তাদেরকে সুচারুরুপে বিন্যাস করা।”
রাাষ্ট্রচিন্তাবিদ ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান একাধারে বাস্তববাদী ও আদর্শবাদী বিজ্ঞান, যা ন্যায়নীতি অনুসন্ধানের দিক থেকে মানবাচরণ সম্পর্কে আলোচনা করে।”
অধ্যাপক সিলি (Seely) বলেন, “রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি যেমন সম্পদ, জীববিদ্যা যেমন জীবন, বীজগণিত যেমন সংখ্যা এবং জ্যামিতি যেমন আয়তন ও বিস্তৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান তেমনি সরকার সম্পর্কিত বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়।” (Political science investigates the phenomena of government as political economy deals with wealth biology with life, algebra with numbers and geometry with space and magnitude.)
সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো সামাজিক বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যা রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ও সরকারের কাঠামো, মানুষের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও আচার-আচরণ, রাষ্ট্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা, আইন এবং বহুবিধ রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা : সময়ের বিচারে বাংলাদেশ একটি নবীন রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে এই দেশটি স্বধীনতা লাভ করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন পর্যাপ্ত পরিমাণে সাধিত হয় নি। তাই দেশটির প্রত্যেকটি নাগরিককে রাজনৈতিকভাবে সচতেন করে তোলা আবশ্যক। এ জন্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের কোনো বিকল্প নেই। নিম্নে বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের উপযোগিতা আলোচনা করা হলোঃ
১. সুনাগরিক হওয়া : বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক তাদের রাজনৈতিক কিংবা রাষ্টীয় অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তাই নাগরিকগণকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হলে রাষ্টবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কেননা রাষ্ট্রের জনগণকে সুনাগরিক হতে হলে অধিকার ও কতর্ব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
২. রাজনৈতিক জ্ঞানলাভ: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের আজো গণতন্ত্র, জনমত, সরকার, রাষ্ট্র সংবিধান, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান নেই। আর উল্লেখিত বিষয়গুলো হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে এসব সম্পর্কে জ্ঞানলাভের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়া সম্ভব।
৩. জ্ঞানের সীমা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কিংবা একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের জ্ঞান অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের ও দেশের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
৪. সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ : বাংলাদেশে আজো বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। এই সমস্ত সমস্যা দূরীকরণের জ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। তাই বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রাবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা আবশ্যক।
৫. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : সুশাসকের জন্য অর্থনৈতিক জ্ঞান থাকা অতীব জরুরি। সেক্ষেত্রে একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদকে রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
৬. সুষ্ঠু গণতন্ত্র কায়েম: বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এখানে গণতান্ত্রিক শাসন নেই। তাই গণতন্ত্রকে সঠিক মাত্রায় প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে।
৭. স্বদেশপ্রেম: দেশপ্রেম নাগরিকের একটি অন্যতম গুণ। দেশপ্রেমিক নাগরিকরাই দেশের প্রকৃত সম্পদ। তাই বাংলাদেশের জনগণকে দেশপ্রেমিক হওয়ার প্রয়োজন। আর এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান। আর এ কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ জরুরি।
৮. সুশাসন প্রতিষ্ঠা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, আইন, ন্যায়বিচার, প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকে। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য এদেশের জনগণের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
৯. বিশ্বশান্তির সহায়ক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান বিশ্বশান্তির সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান মানুষকে উদার ও বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করে, যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা আবশ্যক।
১০. আধুনিকীকরণ সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনঃ সমাজব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্য করা প্রয়োজন আধুনিকীকরণ ছাড়া রাষ্ট্রের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের আধুনিকীকরণের গতিকে তরান্বিত করার জন্য এদেশের জনগণের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, যে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অধিক। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান মানুষকে সমৃদ্ধিশালী, সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে সহায়তা করে।
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
টমাস হবসএর সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে পড়তে নিচের লিং-এ ক্লিক করুন
টমাস হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
+88 01713 211 910