
সিরাজউদ্দৌলা নাটক: মিরজাফর চরিত্র
মিরজাফর চরিত্র্যের বৈশিষ্ট্য :
‘সিরাজউদ্দৌলা' সিকানদার আবু জাফরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র মীর জাফর। সিকানদার আবু জাফর এই চরিত্রকে নির্মাণ করেন রক্তমাংসের গড়া এক বাস্তব মানুষ রূপে। তাই এক দিকে মীর জাফর ব্যক্তিহীন, লোভী, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাস ঘাতক, দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হলেও অন্যদিকে তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় মানবীয় গুণাবলীর সমাবেশ । ইংরেজদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরে ক্ষণিক- দ্বিধা, নবাবকে অন্যায় অত্যাচারে মৃদু প্রতিবাদ এর প্রমাণ ।
মীর জাফর ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব । ইতিহাস থেকে জানা তার আদি নিবাস ছিল পারস্যে। ভাগ্যাম্বষণে তিনি হিন্দুস্থানে আসেন। প্রথমে তিনি নবাব আলীবর্দীর সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক হিসাবে কাজ শুরু করেন । কিন্তু প্রতিভাগুণে তিনি উত্তরকালে প্রধান সেনাপতির পদ অধিকার করেন।
মীর জাফর মর্যাদা সচেতন ছিলেন। দ্বিতীয় অংকের প্রথম দৃশ্যে মীর জাফর নবাবের সঙ্গে দরবারে উপস্থিত । সিরাজ ইতোমধ্যে অবগত হয়েছেন যে, তার অমাত্যগণ ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাস ঘাতক । তিনি আরো অবহিত হয়েছেন যে, মীর জাফর চক্রের প্রত্যক্ষ- সহযোগিতা ও প্রশ্রয়েই ইংরেজগণ এ দেশের প্রজা- সাধারণের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে । নবাব হিসাবে প্রজাদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সিরাজের একান্ত কর্তব্য। কিন্তু নবাব তা পালন করতে পারছেন না ফলে প্রজাদের পক্ষ নিয়ে নবাব ইংরেজ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজ অমাত্যদের কাছে বিচার প্রার্থনা করেন । সিরাজের এ আচরণ মীর জাফরের মর্যাদায় আঘাত করে । তাই উচ্চারণ করে
“নবাব আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনতে চাইছেন ।
এই অযথা দূর্ব্যবহার আমার হৃষ্ট মনে গ্রহণ করতে পারব কি - না সন্দেহ।” [দ্বিতীয় অংক/প্রথম দৃশ্য!
মীর জাফর ছিলেন প্রবঞ্চক। বাংলার ইতিহাসে মীর জাফর তুলনা- রহিত প্রবঞ্চক হিসেবেই খ্যাত । দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে মীর জাফর ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে নবাবের কাছে চিহ্নিত হয় । অতঃপর মীরজাফর কৃতকর্মের জন্য নবাবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন । মহামতি নবাব তাকে ক্ষমা করেন ।মীর জাফর নবাবের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন-
“ আমি আল্লাহর পাক কালাম ছুয়ে ওয়াদা করছি, আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব ।” [দ্বিতীয় অংক/ প্রথম দৃশ্য!
কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী প্রবঞ্চক মীর জাফরের এ ছিল মুখের কথা অন্তঃরের সমর্থন তাতে ছিলনা ।
মীর জাফর প্রতিহিংসা পরায়ণ ছিলেন। ইংরেজগণ স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সাধারণ প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করে । ইংরেজদের হেন আচরণের জন্য নবাব মীর জাফরসহ অন্যান্য আমাত্যদের কাছে কৈফিয়ৎ চান । মীর জাফর নবাবের এ আচরণ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি । এতে তিনি চরম অপমান বোধ করেন । পরিণামে তিনি হয়ে উঠেন চরম প্রতিশোধ পরায়ণ । নবাবের কাছে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করার কথা ভুলে গিয়ে উচ্চারণ করেন-
অগ্নিগিরির মত প্রচন্ড গর্জনে ফেটে পড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছি। বুকের ভেতর আকাঙ্খা আর অধিকার লাভা টগবগ করে ফুটে উঠছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের অসহ্য উত্তাপ।
এবার আমি আঘাত হানবোই । ” [ দ্বিতীয় অংক/দ্বিতীয় দৃশ্য]
মীর জাফর ব্যক্তিত্বহীন ছিলেন । তিনি সম্পূর্ণ রুপে ব্যক্তিহীন, পরতান্ত্রিক। আর এ জন্যই ঐতিহাসিকগণ তাকে ক্লাইভের “ ভারবাহী খচ্ছর” রুপে অভিহিত করেছেন । মীর জাফর বিশ্বাস ঘাতক ছিলেন। বাংলার ইতিহাসে মীর জাফর সবচেয়ে বড় পরিচয় শব্দটি হল বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে। তাকে জাতীয় বেঈমান হিসাবেও অবিহিত করা হয়। মীর জাফর, শব্দটি বাঙালির কাছে বিশ্বাসঘাতক শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবেই গৃহীত হয়েছে । মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই বাঙালির জীবনে নেমে আসে দু'শ বৎসরের ইংরেজ দুঃশাসন । পবিত্র কোরআন ছুয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিজ্ঞা করলেও পলাশীর যুদ্ধে সে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে । অথচ নবাব তাকে বিশ্বাস করেই পলাশীর যুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা ভার অর্পণ করেছিলেন । কিন্তু মীর জাফর তাঁর বিশ্বাস রাখেনি
পৃথিবীতে কোনো মানুষই শুধু ভালো কিংবা শুধু মন্দ নয়। চরম মন্দ লোকের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় দুর্লভ মানবীয় গুণের সমাবেশ। মীর জাফর এর ব্যতিক্রম নন। আলোচ্য নাটকে আমরা তা প্রত্যক্ষ করি । ইংরেজদের সাথে সন্ধি পত্রে স্বাক্ষর করতে গিয়ে তিনি ক্ষণ কালের জন্য হলেও দ্বিধান্বিত হয়েছেন। তিনি বলেছেন-
‘সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না ত? [দ্বিতীয় অঙ্ক/ তৃতীয় দৃশ্য
অন্যদিকে জনসাধারণের মনে ভীতি সৃষ্টির জন্য ক্লাইভের পরামর্শকে তিনি সমর্থন করেন নি । আবার লবণ ব্যবসায়ীদের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের বিবরণ শুনে বিস্ময়ের সাথে মীর জাফর উচ্চারণ করেছেন- ” এতো ডাকাতি।” [ দ্বিতীয় অঙ্ক/প্রথম দৃশ্য
বস্তুত, সিরাজউদ্দৌলা নাটকে বিশ্বাসঘাতকায় ও ষড়যন্ত্রে, লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, ব্যক্তিত্বহীনতায় ও প্রবঞ্চনায়, মীর জাফর তার ইতিহাস- সমর্থিত চরিত্রকেই পোষকতা দান করেছেন । কিন্তু সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী সিকানদার আবু জাফর চরিত্রে আরো কিছু মানবীয় গুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন । যার জন্য তার প্রতি আমাদের শুধু ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্মে না । বরং কখনও কখনও তার প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল হয়ে উঠি।