
NTRCA বাংলাদেশের কবিতায় আহসান হাবিবের অবদান
প্রশ্ন : বাংলাদেশের কবিতায় আহসান হাবিবের অবদান মূল্যায়ন কর।
উত্তর: আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) ছিলেন একই সাথে কবি ও সাংবাদিক। আধুনিক জীবনবোধ ও শিল্প-চেতনাকে আশ্রয় করেই তিনি কাব্য চর্চা করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি কাব্য চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তাঁর কবিতা বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় -‘ছায়াহরিণ’(১৯৬২), ‘সারা দুপুর’ (১৯৬৪), ‘আশায় বসতি’(১৯৭৪), ‘মেঘবলে চৈত্রে যাবো’(১৯৭৬), ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’(১৯৮০), ‘প্রেমের কবিতা’(১৯৮১), ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’(১৯৮৫) ইত্যাদি।
আহসান হাবীবের কবিতার মুখ্য বিষয় ছিল মধ্যবিত্তের জীবন সংকট ও জীবন যন্ত্রণা। তিনি ছিলেন সুকুমার মন ও মননের অধিকারী। তাই আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার নৈরাজ্য, নৈরাশ্য এবং হৃদয়হীনতা তাঁকে গভীরভাবে আহত করেছে। এরই প্রতিফলন তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। এই পৃথিবীরি ধুলিমলিন বাস্তবতা যে বিশুদ্ধ মানব হৃদয়কে গণিকাতে পরিণত করেছে, সে সম্পর্কে তিনি পরিপূর্ণ সচেতন ছিলেন। তাই তিনি প্রত্যাশা করেছেন এই পরিবেশের পরিবর্তন হোক। তিনি আশা করেছেন- শিশুরা আবার সারল্য নিয়ে হাসুক, গণমানুষ ক্ষুধা থেকে মুক্তি পাক, শিল্প-সংষ্কৃতির প্রসার ঘটুক, প্রতিটি আধুনিক মানুষ এক-একজন প্রাণবন্ত ও হৃদয়বান ব্যক্তি হয়ে উঠুক। আহসান হাবীবের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর অনুবাদকৃত লেবাননের কবি খললি জিবরানের একটি কবিতায়। যেমন-
প্রেমে কর্ম্মে যখন সংযোগ
তখন তোমার সেই কর্ম্মে আর প্রেমে
অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাধা
তুমি নিজে
পৃথিবীর সহস্র মানুষ
আর এই মানুষ ও পৃথিবীর
স্রষ্ঠা নিজে। (প্রফেট)
সুকুমার চিত্তবৃত্তির প্রভাবে তিনি সমাজের দুঃখদৈন্যকে স্পষ্টভাবে চিত্রিত করেননি। কিংবা সমাজের জটিলতাকে উন্মোচিত করতে উৎসাহিত হননি। তাঁর কাব্য সাধনা যতই এগিয়েছে তিনি ততই ধীরে ধীরে ইঙ্গিতধর্মী হয়ে উঠেছেন। সমাজদেহকে ছেড়ে তিনি অবলম্বন করেছেন সমাজ চৈতন্যকে। তাই সমালোচক মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ তাঁকে পুরোপুরি রোমান্টিক কবি হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। আবার সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন-আহসান হাবীব বক্তব্যে সমাজ সচেতন কিন্তু শব্দ ব্যবহারের রোমান্টিক।
‘রাত্রিশেষ’ কাব্য গ্রন্থ দেশ বিভাগের পর প্রকাশিত হলেও এর কবিতাগুলো রচিত হয়েছে ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে। ফলে বিষয় হিসেবে এই কাব্যে স্থান পেয়েছে বিভাগপূর্বকালীন যুদ্ধ, মহামারী, দাঙ্গা ও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা, মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাস ভূমি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি বাঙালি মুসলমানের প্রভৃতি স্বপ্নের স্পর্শ লক্ষ করা যায় আহসান হাবীবের এই কাব্যে। ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যের ‘এই মন এই মৃত্তিকা’ কবিতার মধ্যে বাঙালি মুসলমানের এই স্বপ্নের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন:
নিবিড় রঙ্গে আবরণঘণ যে আবরণের তলে
এই পৃথিবীর কুৎসিত প্রাণ হীন কামনায় জ্বলে
প্রেমহীন সেই বন্ধুর দেশে নীড় বাধলাম তবু
এই মন এই মৃত্তিকায় বিচ্ছেদ নাই কভু।
‘ছায়া হরিণ’ কাব্যের কবিতাগুলোর রচনা কালের ব্যাপ্তি ১৯৪৭-১৯৬২ পর্যন্ত। পাকিস্তান নিয়ে কবির মনে যে স্বপ্ন ছিল তা এই পর্বে অম্লান হয়ে এসেছে। বাধা-বন্ধনহীন নিরুপদ্রবে জীবন যাপন করাই তাঁর এখন কাম্য। আত্মজৈবনিক কবিতা ‘সে নেই’ তে তিনি সেটা স্পষ্ট করেছেন। যেমন:
একটু ভরসা দাও মনে
একটু আশ্বাস দাও বেঁচে থাকবার
মাথা রাখবার ঠাঁই দাও।
‘রাত্রিশেষ’ নামকরণের মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিত অনেকটা স্পষ্ট রূপ পায়। তাছাড়া এই কাব্যের মধ্য দিয়েই আহসান হাবীবের কাব্যযাত্রার রূপরেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
যন্ত্রযুগের সভ্যতা যে মানুষকে তার শাশ্বত মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করে হৃদয়কে পণ্যেও সমতুল্য করে তুলেছে, সে কথা তিনি ভালভাবে বলেছেন ‘অন্যদিন’ কবিতায়। যেমন:”
নির্জন নদীর তীরে অপরাহ্ণে ঘাসফুলে
সোনার ফসলে
চোখ রেখে, যে হৃদয় তোমাকে দেবার
কথা ছিল: সে আজ হাটের পণ্য।
তবে প্রবল আশাবাদ লক্ষ করা যায় ‘শুল্ক পক্ষের গান’ কবিতায়। কবি মনে করেন মানবতার অপমান ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজদেহে ব্যাধির মতো। একদিন ব্যাধি দূর হলে সমাজ আবার পূর্ণ স্বাস্থ্যে দীপ্তিমান হবে। যেমন:
এই নিত্য শেষ হওয়া, মুছে যাওয়া এই অপমান
একদা সার্থক হবে পৃথিবী।
‘সারা দুপুর’ কাব্যেও সর্বত্র একটা বেদনার আমেজ ছড়ানো। যদিও এই কাব্যে দুপুরের উজ্জ্বলতা নেই, আছে অপরাহ্নের বেদনা বিধূরতা। বর্হিজগতের আনন্দ ও আশ্বাসহীনতাই এই কারণ। জীবনের প্রাচুর্য যখন লোপ পায় তখন মনের জগতে আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেমন:
মনে হয় শেষ শিখা সর্বশেষ ঝড়ে
নিভে যাবে, আমি নিভে যাব। (এই ঝড়ে এই অন্ধকারে)
কিন্তু দুঃখের দাবদাহের মধ্যেও কবি নিজের ভূমিকাকে বিস্মৃত হন নি। নিজের জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও ভবিষ্যতে বংশধরেরা মুক্ত আলোবাতাসে জীবন ধারণ করুক। এটা তিনি কামনা করেন। যেমন:
আমাদের কিছু ¯স্নেহ
কিছু দোয়া বুকে মেখে নিয়ে যাবে তারা। (রেখে যাবো)
‘আশায় বসতি’ কাব্যটি স্বাধীনতার পর প্রকাশিত হলেও এর কবিতাগুলো রচিত হয় পাকিস্তানের শেষ সময়ে। আহসান হাবীবের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য আশাবাদ। এখানেও তা দুর্লভ নয়। বর্তমানের নিরানন্দময় পৃথিবী পরিবর্তিত হবে আনন্দ ও কল্যাণের রাজ্যে, সেই আশা নিয়ে তিনি দিন কাটাচ্ছেন। একটি কবিতায় তিনি একজন মানুষের কথা বলেছেন যিনি সমাজের জনারণ্যে মানুষ গড়ার কারিগর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। যেমন:
চিত্র নয়, কাব্য নয়, চাই
মানুষ গড়ার জন্য দক্ষ কারিগর তার। ( একটা লোক)
সুতরাং আহসান হাবীবের কাছে মানুষই বড় কথা। মানুষের মহঃ প্রবৃত্তগুলো জাগরিত হোক, মানব জীবনের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূর্ণ হোক। এটাই তার কাম্য।
পাকিস্তান কাল-পরিধিতে রচিত আহসান হাবীবের কবিতা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে স্থির থাকে নি। সাধারণভাবে সমাজ অন্তর্গত মানুষই তার কবিতার মুখ্য বিষয়। তাদের দুঃখ-বেদনা, স্বপ্ন-সম্ভাবনাকেই তিনি তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন। তবে শিল্পশৈলী বা আঙ্গিকে তিনি একেবারেই মনোযোগী হন নি। শব্দ ব্যবহার ও অলঙ্কার নির্মাণেও তিনি যথাযথ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারেন নি। তবে বিষয় ও বক্তব্যের কারণে তাঁর কবিতা বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে বিশিষ্ট্য স্থান দখল করে আছে।
ড. এ. আই. এম. মুসা
অধ্যাপক-বাংলা